নিজস্ব প্রতিবেদক:
নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া'র’ আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তথাকথিত হিজরতের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীনে সশস্ত্র প্রশিক্ষণে অংশ নেয়া ৪ জঙ্গিকে চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারী) বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাদের কে আটক করা হয়।
র্যাব ৭ এর অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল মাহবুব আলম পিপিএম, পিএসসি বলেন, গত ২৩ আগস্ট ২০২২ তারিখে কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে ০৮ জন তরুণের নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। উক্ত নিখোঁজের ঘটনায় নিখোঁজ তরুণদের পরিবার কুমিল্লার কোতয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। গণমাধ্যমসমূহে বহুলভাবে আলোচিত নিখোঁজের এই ঘটনা দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এর প্রেক্ষিতে র্যাব ফোর্সেস নিখোঁজদের উদ্ধারে নজরদারি বৃদ্ধি করে। নিখোঁজ তরুণদের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে র্যাব “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া” নামক একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় থাকার তথ্য পায় এবং র্যাব জানতে পারে যে, এই সংগঠনের সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।
পরবর্তীতে পার্বত্য এলাকায় গত ৩ অক্টোবর ২০২২ তারিখ থেকে নজরদারি বৃদ্ধি করে র্যাব। যার প্রেক্ষিতে ২০ অক্টোবর ২০২২ তারিখ রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি থেকে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের ০৭ জন এবং পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এর ০৩ জনসহ মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র্যাব। গ্রেফতারকৃতদের নিকট হতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের বিভিন্ন পাহাড়ী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। গত ১১ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে বান্দরবানের থানচি ও রোয়াংছড়ি থেকে পাহাড়ে প্রশিক্ষণরত ০৫ সদস্যকে, গত ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা উক্ত সংগঠনের শূরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও বোমা বিশেষজ্ঞ বাশারকে, গত ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখ বান্দরবানের থানচির রেমাক্রী ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ দেশি ও বিদেশি অস্ত্র, বোমা তৈরির সরঞ্জামাদি, গোলাবারুদ ও নগদ ৭ লক্ষাধিক টাকাসহ জঙ্গি সংগঠনের ১৭ জন এবং পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের ০৩ জনসহ মোট ২০ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। বিভিন্ন সময়ে র্যাবের পরিচালিত অভিযানে ইতোমধ্যে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাসহ সর্বমোট ৫৫ জন এবং পাহাড়ে অবস্থান, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কার্যক্রমে জঙ্গিদের সহায়তার জন্য পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’ এর ১৭ জন নেতা ও সদস্যকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃতদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে, এই সংগঠনের আমীর আনিসুর রহমান @মাহমুদ, দাওয়াতী কার্যক্রমের প্রধান মাইমুন, সংগঠনের উপদেষ্টা শামীম মাহফুজ, অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান রাকিব এবং ইতিপূর্বে গ্রেফতারকৃত অর্থ বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক মুনতাছির, দাওয়াতী ও অন্যতম অর্থসরবরাহকারী হাবিবুল্লাহ, সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও বোমা বিশেষজ্ঞ বাশার। সংগঠনের আমীর আনিসুর রহমান @মাহমুদ এর সাথে কেএনএফ এর প্রধান নাথাম বমের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। পরবর্তীতে নাথাম বমের সাথে তাদের অর্থের বিনিময়ে চুক্তি হয়, এরপর পাহাড়ে আশ্রয়, অস্ত্র ও রশদ সরবরাহ এবং সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদান করত।
এরই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব জানতে পারে যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযানের ফলে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের বেশ কয়েকজন সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় থেকে বের হয়ে সমতলে আত্মগোপনে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে গত রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৭ এর অভিযানে চট্টগ্রামের পটিয়া বাইপাস এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ১। হোসাইন আহমদ (২২), দশমিনা, পটুয়াখালী, ২। নিহাল আব্দুল্লাহ (১৯), সদর, কুমিল্লা, ৩। আল আমিন (২২), সদর, কুমিল্লা, ৪। আল আমিন @পার্থ কুমার দাস (২১), ডুমুরিয়া, খুলনা’দেরকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃতরা সহপাঠি, নিকটাত্মীয়, স্থানীয় পরিচিত ব্যক্তি বা বন্ধু বান্ধবের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে উক্ত সংগঠনে যোগদান করে। বিভিন্ন সময়ে জামাতুল আনসারের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা বিশে^র বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের উপর নির্যাতন-নিপীড়নের ভিডিও দেখানো, রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিভিন্ন অনিয়ম, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও বিভিন্ন তাত্তি¡ক জ্ঞান প্রদান করার মাধ্যমে তাদেরকে সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে উৎসাহী করে তুলত। গ্রেফতারকৃতরা বিভিন্ন সময়ে তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়।
তথাকথিত হিজরতের প্রথমে তাদেরকে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের তত্ত¡াবধানে রেখে পটুয়াখালী ও ভোলার চর এলাকা, ঢাকা ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শারীরিক কসরত, জঙ্গিবাদ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, তাত্তি¡ক ও মনস্তাত্তি¡ক জ্ঞান প্রদান করা হত। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে তাদেরকে সমতল হতে পাহাড়ে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হয় এবং শুরা সদস্য রাকিব এর মাধ্যমে তারা পার্বত্য অঞ্চলের বাকলাই পাড়া হয়ে কেটিসি পাহাড়ে প্রশিক্ষণ শিবিরে পৌছায়। পার্বত্য অঞ্চলে তারা বিভিন্ন ধরণের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, বোমা তৈরি বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও প্রতিক‚ল পরিবেশে টিকে থাকা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। গ্রেফতারকৃতরা আরও জানায়, বিভিন্ন সময় কেএনএফ এর নাথান বম, বাংচুং, রামমোয়, ডিকলিয়ান, পাহল এবং কাকুলীসহ অনেকেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আসত। প্রশিক্ষণের জন্য অস্ত্র ও অন্যান্য রসদ তারা অর্থের বিনিময়ে কেএনএফ এর সদস্যদের নিকট হতে সংগ্রহ করত এবং কেএনএফ এর সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে উক্ত জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদান করত বলে জানা যায়। পরবর্তীতে পার্বত্য অঞ্চলে র্যাবের অভিযান শুরু হলে তারা সংগঠনের আমীরের নির্দেশে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করে। তারা ছোট ছোট গ্রæপে সাইজামপাড়া, মুন্নুয়াম পাড়া, রোয়াংছড়ি, পাইক্ষং পাড়া, তেলাং পাড়াসহ পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে। গত ০৪ দিন পূর্বে তারা সমতলে আসার উদ্দেশ্যে পাহাড়ের গহীন থেকে হেঁটে বান্দরবানের টঙ্কাবতী এলাকায় আসে। পরবর্তীতে সিএনজিযোগে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে আসার পথে পটিয়া বাইপাস এলাকা থেকে ০৪ জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং অভিযানকালীন সময়ে আরও ৪-৫ জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
গ্রেফতারকৃত হোসাইন রাজধানীর একটি মাদ্রাসায় অধ্যয়ণরত ছিল। সে ২০২১ সালে সিরাজ এর মাধ্যমে এই সংগঠনে যোগদান করে। পরবর্তীতে সিরাজ তাকে সংগঠনের শুরা সদস্য রাকিবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে সংগঠনের শুরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য বাকলাই পাড়া হয়ে পাহাড়ে কেটিসিতে গমন করে। পাহাড়ে গমনের পর একে-৪৭ সহ বিভিন্ন অস্ত্র চালনা, বোমা প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সামরিক কৌশল বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। সে পাশর্^বর্তী দেশের সীমান্তবর্তী রেংক্লাং পাহাড়সহ পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অবস্থান করে। পরবর্তীতে পাহাড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে তারা বিভক্ত হয়ে ছোট একটি গ্রæপে পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করে।
গ্রেফতারকৃত আল আমিন কুমিল্লার একটি মাদ্রাসায় অধ্যয়ণরত ছিল। সে ২০২১ সালে মাদ্রাসার এক সহপাঠীর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং পূর্বে গ্রেফতারকৃত ফাহিম এর মাধ্যমে উগ্রবাদ সম্পর্কিত বিভিন্ন বই ও পাশর্^বর্তী দেশে মুসলিম নির্যাতনের ভিডিও কন্টেন্ট দেখে সংগঠনে যোগদান করে। পরবর্তীতে তথা কথিত হিজরতের নামে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে পরিবার থেকে নিরুদ্দেশ হয়। এসময় বিভিন্ন ব্যক্তির তত্ত¡াবধানে থেকে জঙ্গিবাদ বিষয়ক বিভিন্ন তাত্তি¡ক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে গত ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে সংগঠনের শুরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ে গমন করে। পাহাড়ে আসার পর সে সব ধরণের অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিল।
গ্রেফতারকৃত মোঃ আল আমিন (নওমুসলিম) স্থানীয় একটি বিদ্যালয় থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে। সে ২০১৮ সালে স্থানীয় এক ইমামের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর সে রাজধানীতে চলে আসে এবং সিকিউরিটি গার্ডের চাকুরি করা শুরু করে। সে সিরাজের মাধ্যমে সংগঠনটিতে যোগদান করে। পরবর্তীতে ২০২১ সালের নভেম্বরে শূরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য পার্বত্য অঞ্চলে গমন করে। পাহাড়ে আসার পর সে সব ধরণের অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিল।
গ্রেফতারকৃত নিহাল আব্দুল্লাহ এইচএসসি ১ম বর্ষের ছাত্র ছিল। সে ২০২০ সালের শেষের দিকে তার এক বন্ধুর মাধ্যমে কুবা মসজিদের পূর্বে গ্রেফতারকৃত ইমাম হাবিবুল্লাহ এর সাথে পরিচয় হয় এবং তার মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সংগঠনে যোগদান করে। সে গত ২৩ আগস্ট ২০২২ তারিখ তথাকথিত হিজরতের জন্য বাসা থেকে বের হয়। এসময় কুমিল্লা, পটুয়াখালী, সাভার ও চাঁদপুর এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তির তত্ত¡াবধানে থেকে জঙ্গিবাদ বিষয়ক বিভিন্ন তাত্তি¡ক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। সে হিজরতে থাকাকালীন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনার উপর তার নেতৃত্বে একটি হামলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল; কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারনে তাদের সেই হামলার পরিকল্পনা নসাৎ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে সংগঠনের শুরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য বাকলাই পাড়া হয়ে কেটিসিতে গমন করে। কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া ০৮ তরুণের মধ্যে সে একজন। পাহাড়ে আসার পর সে সব ধরণের অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিল।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।